গরুর গলা ফোলা রোগের চিকিৎসা: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

গরুর গলা ফোলা রোগের চিকিৎসা – গরুর গলাফুলা রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ দেখার সাথে সাথে প্রতিকারমূলক প্রয়োজনীয় চিকিৎসার মাধ্যমে কখনও কখনও এই রোগ থেকে পশুকে বাঁচানো যায়। তবে গরুর গলাফুলা রোগের চিকিৎসার চেয়ে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর পশুর জন্য গলাফুলা রোগের টিকাই উত্তম ও কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।

গরুর গলা ফোলা রোগে (Bloat) সতর্কতা অবলম্বন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি একটি দ্রুতগতি ও প্রাণঘাতী রোগ। নিচে গরুর গলা ফোলা রোগের চিকিৎসা এবং লক্ষণ দেখলে করণীয় কি সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।

গরুর গলা ফোলা রোগের কারণ

গরুর গলা ফোলা রোগ বলতে প্রধানত দুটি ভিন্ন কারণে সৃষ্ট রোগকে বোঝানো হয়, যার লক্ষণগুলো গলায় ফোলাভাব সৃষ্টি করে:

  • হেমোরেজিক সেপটিসেমিয়া 
  • ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ

এই দুটি রোগের কারণ নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. হেমোরেজিক সেপটিসেমিয়া 

এটি একটি অত্যন্ত সংক্রামক ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ।

রোগের কারণ: Pasteurella multocida নামক এক ধরনের গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এই রোগ হয়। এই ব্যাকটেরিয়া সাধারণত সুস্থ পশুর শ্বাসতন্ত্রে সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সক্রিয় হয়ে রোগ সৃষ্টি করে।

ছড়িয়ে পড়ার কারণ: পরিবেশগত চাপ (Stress): আবহাওয়ার আকস্মিক পরিবর্তন, বিশেষ করে বর্ষার শুরু ও শেষে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ, অতিরিক্ত গরম বা ঠাণ্ডা, পরিবহনজনিত ধকল, পুষ্টিহীনতা, লিভার কৃমির সংক্রমণ – এ সবই পশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দেয় এবং ব্যাকটেরিয়াকে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ করে দেয়।

  • এছাড়াও আক্রান্ত পশুর লালা, মলমূত্র, নাক ও মুখ নিঃসৃত তরল পদার্থের মাধ্যমে এই ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ে।
  • ব্যাকটেরিয়া দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমেও সুস্থ গরুতে সংক্রমিত হতে পারে।
  • আক্রান্ত গরুর সাথে সরাসরি সংস্পর্শে আসার মাধ্যমেও রোগ ছড়ায়।
  • সব বয়সের পশুই আক্রান্ত হতে পারে, তবে ৬-১৮ মাস বয়সী বাড়ন্ত পশুরা এই রোগে বেশি সংবেদনশীল।
  • সাধারণত বর্ষার শুরুতে ও শেষে এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।

২. ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ (LSD) এর কারণ

এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা সাম্প্রতিক সময়ে অনেক খামারির ক্ষতির কারণ হয়েছে।

রোগের কারণ: ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ ভাইরাস Capripoxvirus গণের অন্তর্গত দ্বারা এই রোগ হয়। এটি পক্সভিরিডি পরিবারের একটি ভাইরাস। 

📌আরো পড়ুন 👉 এঁটেল মাটি কাকে বলে?

ছড়িয়ে পড়ার কারণ: এই রোগের প্রধান বাহক হলো মশা ও মাছি। এছাড়াও আঁঠালি (টিক), মাইট এবং অন্যান্য রক্তচোষা পোকামাকড় আক্রান্ত পশু থেকে সুস্থ পশুর রক্তে ভাইরাস বহন করে রোগ ছড়ায়।

  • এছাড়াও আক্রান্ত পশুর লালা দ্বারা দূষিত খাবার বা পানি খেয়েও সুস্থ গরু আক্রান্ত হতে পারে।
  • আক্রান্ত পশুর গুটি ফেটে তৈরি হওয়া ক্ষত এবং সেখান থেকে বের হওয়া পুঁজ রোগ ছড়াতে পারে।
  • আক্রান্ত পশুর চিকিৎসায় বা পরিচর্যায় ব্যবহৃত দূষিত সিরিঞ্জ, সুঁই বা অন্যান্য সরঞ্জাম পরিষ্কার না করে অন্য গরুতে ব্যবহার করলে রোগ ছড়াতে পারে।
  • ভাইরাস আক্রান্ত ষাঁড়ের সিমেনেও এই ভাইরাস থাকতে পারে, ফলে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমেও রোগ ছড়াতে পারে।
  • আক্রান্ত গাভী থেকে বাছুর দুগ্ধ পানের মাধ্যমেও আক্রান্ত হতে পারে, বিশেষ করে যদি ওলানে ক্ষত থাকে।
  • এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অসুস্থ গরু পরিবহন করলে রোগের বিস্তার দ্রুত ঘটে।
  • সাধারণত মশা-মাছির বংশ বিস্তারের সময়, যেমন বর্ষার শেষে, শরতের শুরুতে বা বসন্তের শুরুতে এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।

উভয় ক্ষেত্রেই, অপুষ্টি, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, এবং অন্যান্য রোগের (যেমন কৃমির সংক্রমণ) কারণে পশু দুর্বল থাকলে এই রোগগুলোর ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং রোগের তীব্রতা মারাত্মক হতে পারে। গরুর গলা ফোলা রোগের কারণ জানতে পারলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ হয়।

গরুর গলাফুলা রোগের লক্ষণ

প্রাথমিক অবস্থায় গরুর গলাফুলা রোগের লক্ষণ হিসেবে কোনো প্রকার উপসর্গ দেখা যায় না বিধায় এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর পশুকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য খুব বেশি সময় পাওয়া যায় না। গরুর তড়কা রোগের ন্যায় গলাফুলা রোগের ক্ষেত্রেও অতিতীব্র ও তীব্র এই দুই প্রকৃতির হয়ে থাকে। নিচে গরুর গলাফুলা রোগের লক্ষণসমূহ উপস্থাপন করা হলো:

  • গরুশ্বাসকষ্ট দেখা দেয় 
  • গরু জিহ্বা বের করে হাপাতে পারে 
  • গরু কাশতে পারে।
  • গরুকে দেখতে ক্লান্ত ও দূর্বল মনে হয়।
  • চোখে ময়লা জমে পিচুটি পড়তে পারে।
  • গরু খাওয়া আগের তুলনায় অনেক কমে যেতে পারে। 
  • গরু শীর্ণকায় হয়ে পড়তে পারে।
  • গরুর তল পেট ফুলে উঠতে পারে।
  • গলা ফুলে ওঠায় গলা দিয়ে গড়গড় শব্দ হওয়ার সাথে কাশি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।

গরুর তীব্র মাত্রার গলা ফোলা রোগের লক্ষণঃ

  • গরুকে দেখতে ক্লান্ত ও দূর্বল মনে হয়।
  • গরুর গায়ে হঠাৎ প্রচন্ড জ্বর দেখা দেয়, জ্বরের মাত্রা ১০৬° থেকে ১০৭° এর বেশি উঠে যেতে পারে।
  • মারাত্মক সংক্রমণ হলে গরুর নাক, মুখ বা গাল দিয়ে লালা ঝরতে থাকে।

গরুর গলা ফোলার লক্ষণ দেখা মাত্রই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। ১-২ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা না করলে প্রাণ হারানোর আশঙ্কা থাকে।

গরুর গলা ফোলা রোগের চিকিৎসা

গরুর গলা ফোলা রোগ বলতে দুটি প্রধান রোগকে বোঝানো হয়: ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ (LSD) এবং হেমোরেজিক সেপটিসেমিয়া (HS) বা বাদলা রোগ। এই দুটি রোগের কারণ এবং চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্ন, তাই নিচে আলাদাভাবে আলোচনা করা হলো।

গরুর গলা ফোলা রোগের চিকিৎসা

যেকোনো চিকিৎসার আগে অবশ্যই একজন রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নিজ থেকে চিকিৎসা না করে বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া জরুরি।

১. ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ (LSD) এর চিকিৎসা

ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ একটি ভাইরাসজনিত রোগ, তাই এর কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা নেই। চিকিৎসা মূলত লক্ষণভিত্তিক এবং রোগাক্রান্ত পশুকে আরাম ও সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে করা হয়।

✅চিকিৎসা পদ্ধতি ও করণীয়: 

📌আরো পড়ুন 👉 মানব ভূগোল কাকে বলে?

➡️আক্রান্ত পশুকে আলাদা করা: রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে আক্রান্ত গরুকে সুস্থ গরু থেকে আলাদা করে বিচ্ছিন্ন স্থানে রাখতে হবে, যাতে রোগ ছড়িয়ে না পড়ে।

➡️পশু চিকিৎসকের পরামর্শ: অবিলম্বে একজন পশু চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন।

➡️জ্বর ও ব্যথা কমানো: গরুর যদি উচ্চ জ্বর থাকে (১০৪-১০৬° ফাঃ), তবে প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দেওয়া যেতে পারে।

➡️ক্ষত পরিচর্যা: গুটি বা ফোসকা ফেটে গেলে সৃষ্ট ক্ষতস্থানগুলো পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। টিংচার আয়োডিন, পোভিডোন আয়োডিন, বা ০.১% পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণ দিয়ে দিনে ২-৩ বার ক্ষতস্থান ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে।

ক্ষতস্থান পরিষ্কার করার পর অ্যান্টিবায়োটিক মলম (যেমন – নেওমাইসিন বা জেন্টামাইসিনযুক্ত মলম) বা ডাস্টিং পাউডার ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন রোধ করবে এবং ক্ষত শুকাতে সাহায্য করবে।

কিছু ক্ষেত্রে, নিমপাতা বাটা, গুড়, খাবার সোডা এবং লবণ মিশিয়ে প্রাকৃতিকভাবেও ক্ষত শুকাতে সাহায্য করা হয়, তবে এর কার্যকারিতা বৈজ্ঞানিকভাবে নিশ্চিত নয় এবং এটি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে করতে হবে।

➡️সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন রোধ: ভাইরাসজনিত রোগ হলেও, ক্ষতে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রোধে বা নিউমোনিয়া, পায়ের ফোলা বা অন্যান্য সেকেন্ডারি ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণে পশু চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন। সাধারণত, ব্রড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক যেমন অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, পেনিসিলিন, বা সেফটি ওফার ব্যবহার করা হয়।

➡️পুষ্টিকর খাবার ও পানি: আক্রান্ত গরুকে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। জ্বর বা ব্যথার কারণে গরুর রুচি কমে যেতে পারে। এক্ষেত্রে নরম ও সহজে হজমযোগ্য খাবার দিন।

গরুর পানিশূন্যতা রোধ করতে এবং শক্তি যোগাতে স্যালাইন (যেমন – রিংগার্স ল্যাকটেট) বা গ্লুকোজ দ্রবণ ইন্ট্রাভেনাস (শিরায়) বা ওরাল (মুখ দিয়ে) দেওয়া যেতে পারে।

➡️মশা-মাছি নিয়ন্ত্রণ: মশা-মাছি এই রোগের বাহক, তাই খামারে মশা-মাছি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আক্রান্ত গরুকে মশারির নিচে রাখা বা ইনসেক্টিসাইড ব্যবহার করা যেতে পারে।

২. হেমোরেজিক সেপটিসেমিয়া (HS) বা বাদলা রোগের চিকিৎসা

হেমোরেজিক সেপটিসেমিয়া (HS) একটি তীব্র ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ এবং এর জন্য দ্রুত ও কার্যকর চিকিৎসা জরুরি, কারণ এই রোগে পশুর মৃত্যুর হার অনেক বেশি।

✅চিকিৎসা পদ্ধতি ও করণীয়:

দ্রুত পশু চিকিৎসকের পরামর্শ: এই রোগ অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং মারাত্মক হতে পারে, তাই লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে দেরি না করে পশু চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। সময় মতো চিকিৎসা না হলে ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পশু মারা যেতে পারে।

➡️অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ:

পশু চিকিৎসক রোগ নির্ণয় করে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করবেন। পেনিসিলিন, অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, সালফোনামাইড বা অন্যান্য ব্রড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক এই রোগের চিকিৎসায় কার্যকর। সাধারণত, উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক intramuscular (মাংসপেশীতে) বা intravenous (শিরায়) ইনজেকশন হিসেবে ৪-৫ দিন ধরে দেওয়া হয়। যেমন:

অক্সিটেট্রাসাইক্লিন: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৫-৮ মিলিগ্রাম হিসেবে মাংসপেশীতে ২৪ ঘণ্টা পরপর ৪-৫ দিন দেওয়া যেতে পারে।

➡️জ্বর ও ব্যথা কমানো: জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল এবং ব্যথার জন্য এনএসএআইডি (NSAID) ঔষধ দেওয়া যেতে পারে।

➡️সাপোর্টিভ থেরাপি: পশুর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং দুর্বলতা কাটাতে ভিটামিন (যেমন – ভিটামিন বি কমপ্লেক্স) ও মিনারেল সাপ্লিমেন্ট দেওয়া যেতে পারে। পানিশূন্যতা রোধে স্যালাইন (যেমন – রিংগার্স ল্যাকটেট) প্রয়োগ করা যেতে পারে। আক্রান্ত পশুকে আলাদা করা: রোগ ছড়ানো এড়াতে আক্রান্ত পশুকে অন্য পশু থেকে দ্রুত আলাদা করে রাখতে হবে।

➡️প্রতিরোধ: উভয় রোগের ক্ষেত্রেই টিকাকরণ হলো প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এছাড়াও খামারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, জীব নিরাপত্তা (Biosecurity) নিশ্চিত করা এবং মশা-মাছি নিয়ন্ত্রণ রোগের বিস্তার রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মনে রাখবেন, আক্রান্ত পশুর জীবন বাঁচাতে দ্রুত এবং সঠিক চিকিৎসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই দেরি না করে অবিলম্বে একজন অভিজ্ঞ পশু চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।

গরুর গলা ফোলা রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে চিকিৎসা না করালে বা দেরিতে চিকিৎসা করালে গরুকে বাচানো সম্ভব হয় না। তাই লক্ষণ প্রকাশের সাথে সাথে নিম্নের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে-

১. ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ কমাতে এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন যেমন,

  • Penicillin গ্রুপের ইঞ্জেকশন Ampicillin 500ml vet inj. 
  • অথবা Tetracycline A-Tetra vet inj. 
  • অথবা Erythromycin গ্রুপের ইনজেকশন
  • অথবা Sulfonamide গ্রুপের ইঞ্জেকশন লেবেলে থাকা মাত্রা ও নির্দেশনা অনুযায়ী গরুর মাংশে প্রয়োগ করতে হবে।

২. গলায় ফোলা বা স্ফিতি দেখা দিলে সিরিঞ্জের সুচ দিয়ে ফুটো করে চেপে চেপে রস বের করে দিতে হবে।

গরুর গলা ফোলা রোগে সতর্কতা

গরুর গলা ফোলা রোগ, যা সাধারণত ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ (LSD) নামে পরিচিত, এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ এবং গবাদি পশুর জন্য অত্যন্ত ছোঁয়াচে ও মারাত্মক হতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত পশুর চামড়ায় গুটি বা ফোসকা দেখা যায়, যা পরবর্তীতে ফেটে গিয়ে ক্ষত তৈরি করে। এই রোগ থেকে গরুকে সুরক্ষিত রাখতে এবং এর বিস্তার রোধ করতে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।

গরুর গলা ফোলা রোগে সতর্কতা

এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা আলোচনা করা হলো:

টিকাকরণ: ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো সময়মতো গরুকে টিকাদান করা। সরকারি পশু হাসপাতাল বা ভেটেরিনারি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আপনার গরুকে নিয়মিত টিকা দিন। এটি রোগের তীব্রতা এবং ছড়িয়ে পড়া কমাতে সাহায্য করে।

আক্রান্ত গরুর বিচ্ছিন্নকরণ: যদি আপনার খামারে কোনো গরুর মধ্যে গলা ফোলা রোগের লক্ষণ দেখা যায়, তবে অবিলম্বে সেটিকে সুস্থ গরু থেকে আলাদা করে ফেলুন। আক্রান্ত গরুকে একটি বিচ্ছিন্ন স্থানে রাখুন যাতে রোগটি অন্য গরুতে ছড়িয়ে না পড়ে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: খামার এবং গরুর বাসস্থান নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। মশা-মাছি এই রোগের বাহক হতে পারে, তাই মশা-মাছি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করুন। গোয়ালঘরে জমে থাকা গোবর ও আবর্জনা নিয়মিত পরিষ্কার করুন।

বাহ্যিক পরজীবী নিয়ন্ত্রণ: মশা, মাছি, আঠালি (এক প্রকার ক্ষুদ্র পোকা) এবং অন্যান্য বাহ্যিক পরজীবী নিয়ন্ত্রণে রাখুন। এই পরজীবীগুলো রোগের বিস্তার ঘটাতে পারে। প্রয়োজন অনুযায়ী কীটনাশক স্প্রে ব্যবহার করতে পারেন, তবে অবশ্যই পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে।

নতুন গরু কেনার সময় সতর্কতা: নতুন গরু কেনার সময় নিশ্চিত করুন যে গরুটি সুস্থ এবং রোগের কোনো লক্ষণ নেই। সম্ভব হলে, নতুন গরুকে সরাসরি আপনার খামারে প্রবেশ করানোর আগে কিছুদিনের জন্য আলাদা করে পর্যবেক্ষণ করুন।

খাদ্য ও পানি ব্যবস্থাপনা: গরুকে পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ পানি এবং পুষ্টিকর খাবার দিন। একটি সুস্থ ও শক্তিশালী শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকে।

মৃত পশুর সঠিক নিষ্পত্তি: যদি কোনো গরু এই রোগে মারা যায়, তবে সেটির দেহ সঠিকভাবে নিষ্পত্তি করুন। খোলা জায়গায় ফেলে রাখবেন না, কারণ এটি রোগের বিস্তার ঘটাতে পারে। মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা বা গভীর গর্তে পুঁতে ফেলার ব্যবস্থা করুন।

চিকিৎসকের পরামর্শ: যদি আপনার গরুর মধ্যে গলা ফোলা রোগের কোনো লক্ষণ দেখা যায়, তবে দেরি না করে নিকটস্থ পশু চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। সময় মতো চিকিৎসা শুরু করলে রোগের জটিলতা কমানো সম্ভব।

গলা ফোলা রোগ প্রতিকারের উপায় 

গরুর গলা ফোলা রোগ, যা প্রধানত ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ (LSD) নামে পরিচিত, এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এটি গবাদি পশুর জন্য অত্যন্ত মারাত্মক হতে পারে। এই রোগের  প্রতিকার ও করণীয় আলোচনা করা হলো:

ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ (LSD) এর প্রতিকার ও করণীয়

ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ একটি ভাইরাসজনিত রোগ হওয়ায় এর নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা নেই। এক্ষেত্রে মূলত লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা এবং পশুকে আরাম দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

➡️করণীয়:

  • আক্রান্ত গরুকে দ্রুত সুস্থ গরু থেকে আলাদা করে বিচ্ছিন্ন স্থানে রাখতে হবে, যাতে রোগটি ছড়িয়ে না পড়ে।
  • রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে স্থানীয় পশু চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। তিনিই সঠিক রোগ নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে পারবেন।
  • গরুর যদি উচ্চ জ্বর থাকে, তবে প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দেওয়া যেতে পারে।
  • ব্যথানাশক ঔষধ প্রয়োগ করে গরুকে আরাম দেওয়া যেতে পারে।

ক্ষত পরিচর্যা: গুটি বা ফোসকা ফেটে গেলে সৃষ্ট ক্ষতস্থানগুলো পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। টিংচার আয়োডিন, পোভিডোন আয়োডিন, বা পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণ দিয়ে দিনে ২-৩ বার ক্ষতস্থান ধুয়ে ডাস্টিং পাউডার বা অ্যান্টিবায়োটিক মলম ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন রোধ হবে এবং ক্ষত শুকাতে সাহায্য করবে।

অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার: যদিও এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ, তবে ক্ষতে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রোধে বা সেকেন্ডারি ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণে পশু চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন।

পুষ্টিকর খাবার ও পানি: আক্রান্ত গরুকে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি দিতে হবে যাতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী থাকে। যদি গরুর খেতে অনীহা থাকে, তবে স্যালাইন বা গ্লুকোজ দেওয়া যেতে পারে।

মশা-মাছি নিয়ন্ত্রণ: এই রোগের প্রধান বাহক মশা-মাছি, তাই খামারে মশা-মাছি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আক্রান্ত গরুকে মশারির নিচে রাখা যেতে পারে।

➡️প্রতিকার:

টিকাকরণ: ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো সময়মতো টিকাদান। বর্তমানে এই রোগের জন্য টিকা সহজলভ্য। পশু চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি অনুসরণ করতে হবে। গোট পক্স ভ্যাকসিনও এই রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: খামার এবং গরুর বাসস্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা খুবই জরুরি।

জীব নিরাপত্তা (Biosecurity): খামারে নতুন গরু আনার আগে সেগুলোকে আলাদা রেখে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। আক্রান্ত এলাকায় গরুর চলাচল সীমিত করা।

সরঞ্জাম জীবাণুমুক্তকরণ: আক্রান্ত গরুর পরিচর্যায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। একই সিরিঞ্জ একাধিক গরুর জন্য ব্যবহার করা যাবে না।

মৃত পশুর সঠিক নিষ্পত্তি: মৃত পশুর দেহ মাটিতে পুঁতে ফেলা বা পুড়িয়ে ফেলা উচিত, যাতে রোগের বিস্তার না ঘটে।

যেকোনো রোগের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত অভিজ্ঞ পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং তার নির্দেশনা মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক সময়ে চিকিৎসা এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব।

লেখকের শেষ মতামত

পরিশেষে বলব, গলা ফোলা রোগ প্রতিরোধই সর্বোত্তম উপায়। নিয়মিত খাদ্য ব্যবস্থাপনা, পর্যবেক্ষণ ও যত্নের মাধ্যমে আপনি সহজেই এই রোগ থেকে গরুকে রক্ষা করতে পারবেন।

Sharing is Caring

Author name

Leave a Comment